চাই একজন বিদ্রোহী ও জাগরণের কবি
মুহাম্মদ জাকারিয়া শাহনগরী
----------------------
কবি ও কবিতায় সমগ্র বাংলদেশ তথা সমগ্র বিশ্ব আচ্ছাদিত। কিন্ত খুঁজে পাওয়া যায়না গণমানুষের কবি ও কবিতা।
যাঁরা কবি ও কবিতা লেখেন তাঁরা গণমানুষের দুঃখ-দূর্দশা মোছনে কতটুকু কাজ করতে পারছেন জানিনা। জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ, বিদ্রোহী ও সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম , মানবতার কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলোর দিকে তাকালে আমরা নিশ্চয় বুঝতে পারবো, তাঁরা তাঁদের কবিতা দিয়ে গণমানুষের কত কাছাকাছি ছিলেন।
আমাদের বর্তমান কবিরা যেন প্রেম আবেগের কবিতা দিয়ে বিশ্বকে সাজিয়ে দিতে চান। বিশ্বকে ভরপুর করে দিতে চান শুধুই প্রেম দিয়ে। এটা একটা ভাল দিক বলতে পারি। কারণ একটি সমাজ গড়তে মানুষ মানুষে প্রেম অত্যাবশ্যক। কিন্তু এইযে মানব প্রেম তা বিতায় পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। কবিতায় যা দেখা যাচ্ছে তা শুধুমাত্র নর আর নারীর মধ্যকার প্রেম যা সভ্য সমাজ গড়তে কোন সাহায্য করছেনা। প্রকৃত মানব প্রেমের জন্য যে জিনিসটা প্রয়োজন সেই জিনিসটা এসব কবিতার মাধ্যমে কতটুকু সফলতা অর্জিত হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
ইতিহাস সাক্ষী – মানুষ ও মানবতার কবিতা লিখে অতীতের কবিরা হয়েছিলেন বিশ্ববরেণ্য। মানবমুক্তির লক্ষ্যে মানুষ ও মানবতার কবিতা লিখে তাঁরা নিজেরাই কারাবরণ করে মানুষদের মুক্তির পথ প্রসার করেছিলেন। ক্ষমতাশালীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাঁরা চালিয়েছিলেন মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শাব্দিক শানিত তলোয়ার। তাঁদের সেই শাব্দিক শানিত তলোয়ারের আঘাতে কাঁপিয়েছিল স্বৈরাচারী সব সরকারের মসনদ।
কিন্তু আজিকার কবি ও কবিতায় সেই শাব্দিক তলোয়ারের আঘাত যেন নিষ্ক্রীয়। দিকে দিকে চলছে অন্যায়-অনাচার। স্বৈরাচারী সব শাসক পরিবেষ্টিত সমগ্র পৃথিবীর জনপদ। চুষে নিচ্ছে তারা বিশ্ব মানবতার রক্ত। বিশ্ব মানবতাকে করছে তারা হত্যা-বন্ধী। অথচ প্রতিবাদী কেহই নেই ! নেই প্রতিবাদের কোন সংগ্রামী আয়োজন। মানবতার ধারক কবি সাহিত্যিকরাও আজ যেন সেইসব স্বৈরশাসকের ভয়ে মুখে কলুপ এঁটে বসে আছে। তাঁদের প্রতিবাদী কন্ঠ আজ যেন স্তব্ধ । তাঁরা যেন আজ নির্বাক জড়পদার্থের মত নিশ্চল ! না ভয়ে কুঞ্চিত , না ঘুষ খেয়ে টলে পড়া এইসব প্রতিবাদী কন্ঠ বুঝা যাচ্ছেনা। মানবতার মুখপাত্র হয়ে যাঁরা মানবতা রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁরাই যদি হয় এমন ভয়কাতুরে বা স্বৈরশাসকদের আপনজন হয়ে তাদের পক্ষ নিয়ে চুপ থাকবে, তবে কি করে হবে মানবতার রক্ষা ? কি করে আসবে শান্তি অশান্তির সব জনপদে ?
বর্তমান বিশ্বের এই দূর্যোগপূর্ণ সময়ে দেখা দিয়েছে এক একজন বিদ্রোহী কবি ও জাগরণের কবির প্রয়োজনীয়তা। তাই, সকল কবিদের মধ্য থেকে চাই একজন বিদ্রোহী কবি আর একজন জাগরণের কবি, যাঁরা মানুষদের জাগ্রত করবেন তাঁদের শক্তি জাগানিয়া কাব্য দিয়ে। যাঁরা সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের কবিতা নামক শাব্দিক শানিত তলোয়ার দিয়ে সকল অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষদের লড়তে শক্তি জোগাবেন।
প্রেমকাব্য নয়, এখন সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্রোহী ও জাগরণী কাব্য। এই দুই কাব্য যখন একীভুত হয়ে অবস্থান করবে তখন প্রেম কাব্য আর লিখতে হবেনা। মানুষের মাঝেই এমনিতেই জন্ম নিবে প্রেম ও আদর্শিক সভ্যতা। তাই, প্রেমের কবি ও কবিতার জনপদ নয়, চাই জাগরণ ও বিদ্রোহী কবি ও কবিতার জনপদ।
এখানে শুধু একজন বিদ্রোহী কবির মানবতা বিষয়ক কিছু নিদর্শন পেশ করতে চাই, যাতে আমাদের বর্তমান কবিরা একটু হলেও মানুষ ও মানবতা নিয়ে কাজ করার প্রেরণা পেতে পারেন।
“ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর চির জনমের হারানো গৃহলক্ষ্মী নার্গিসকে জীবনের শেষ ও একমাত্র পত্রে লিখেছিলেন, ‘তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না—আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।’ নজরুলের এই কথাগুলো যে কতখানি সত্য, তা অনুধাবনের জন্য খুব বড় গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। নার্গিসের সঙ্গে প্রেম, পরিণয় ও বিচ্ছেদের দাহে দৌলতপুর-ফেরত কবি যখন জ্বলছেন অন্তরে-বাইরে, সেই সময় বেরুতে থাকে তাঁর অবিস্মরণীয় রচনাগুলো। একে একে প্রকাশিত হয় পলাতকা, আজান, দহনমালা, দুপুর অভিসার, বিজয়ের গান, মা, কার বাঁশি বাজিল, লক্ষ্মীছাড়া, অনাদৃতা, রণভেরী, বাদল দিনে, দিল দরদী, অকরুণ প্রিয়া, আগমনী, আনোয়ার, মরণ বরণ, খোকার বুদ্ধি, কামাল পাশা, হারা-মনি, চিরন্তনী প্রিয়া, অ-কেজোর গান, ছল কুমারী, ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম (তিরোভাব), বিজয়িনী, বন্দী বন্দনা, নিশীথ প্রিতম, খোকার গল্প বলা, চিঠি আবাহন, অভিমানী, আরবী ছন্দ, ভাঙার গান, প্রলয়োল্লাস এবং বিদ্রোহীর মতো কবিতা। আর সজীব হয়ে উঠল বাংলা সাহিত্যের শ্মশান, গোরস্থান। ধামা ধরা, জামা ধরার দিন শেষ হয়ে এলো নতুন প্রভাত। নতুন এবং অনন্য সাধারণ। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে? আকাশ কাঁপে তারার আলোর গানের ঘোরে। বিষম তোমার বহ্নিঘাতে বারে বারে আমার রাতে জ্বালিয়ে দিল নতুন তারা ব্যথার ভরে।’ আবুল কালাম শামসুদ্দীনের মতো বিদগ্ধ সাহিত্য সমালোচক আবিষ্কার করলেন, এক মহান ‘যুগ প্রবর্তক’ কবির আবির্ভাব হয়েছে। তিরিশের তিন কবির মনের অবস্থা জেনে নেয়া যেতে পারে। যার মধ্য দিয়ে ৯০ বছর আগের মানুষরা কীভাবে দেখেছিলেন বিদ্রোহীকে তারও সন্ধান পাওয়া যাবে। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কালের পুতুলে’ লিখেছেন ঃ ‘‘ ‘বিদ্রোহী’ পড়লুম ছাপার অক্ষরে মাসিকপত্রে—মনে হলো এমন কখনো পড়িনি। অসহযোগের অগ্নিদীক্ষার পরে সমস্ত মন-প্রাণ যা কামনা করছিলো, এ যেন তাই; দেশব্যাপী উদ্দীপনার এই যেন বাণী।’’ প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখে গেছেন ঃ ‘বাংলা সাহিত্যে এই শতাব্দীর তৃতীয় দশকের গোড়ায় একবার কিন্তু এমনি অকস্মাত্ তুফানের দুরন্ত দোলা লেগেছিল। সে দোলা যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে সেদিন অনুভব করেননি তাদের পক্ষে শুধু লিখিত বিবরণ পড়ে সে অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ স্বাদ পাওয়া বোধ হয় সম্ভব নয়।... রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার তখন মধ্যাহ্ন দীপ্তি। দেশের যুবগণের মনে তাঁর আসনও পাকা। তারই মধ্যে হঠাত্ আর একটা তীব্র প্রবল তুফানের ঝাপটা কাব্যের রূপ নিয়ে তরুণ মনকে উদ্বেল করে তুলেছিলো— আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি— আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি। কবিতার ছন্দে ও ভাষায় এটি উত্তাল তরঙ্গ। কার কণ্ঠে ধ্বনিত এ প্রচণ্ড কল্লোল? কিশোর জগতে একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল, জেগে উঠেছিল একটা রোমাঞ্চিত শিহরণ। মনে আছে, বন্ধুবর কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত একটি কাগজ কোথা থেকে কিনে নিয়ে অস্থির উত্তেজনার সঙ্গে আমার ঘরে ঢুকেছিলেন। কাগজটা সামনে মেলে ধরে বলেছিলেন, পড়। অনেক কষ্টে যোগাড় করেছি। রাস্তায় কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে এ কাগজ নিয়ে। কি সে এমন কাগজ? নেহাত সাধারণভাবে ছাপা, যতদূর মনে পড়ছে ডবল ডিমাই সাইজ-এর সাপ্তাহিক কাগজ। পাতাগুলো আলগা, সেলাই করা নয়। দাম বোধ হয় চার পয়সা। সেই কাগজ কেনবার জন্য সারা শহর ক্ষেপে গেছে? কেন?... পড়লাম কবিতার নাম বিদ্রোহী। ... সেদিন ঘরে বাইরে, মাঠে ঘাটে রাজপথে সভায় এ কবিতা নীরবে নয়, উচ্চকণ্ঠে শত শত পাঠক পড়েছে। সে উত্তেজনা দেখে মনে হয়েছে যে, কবিতার জ্বলন্ত দীপ্তি এমন তীব্র যে ছাপার অক্ষরই যেন কাগজে আগুন ধরিয়ে দেবে। ...গাইবার গান নয়, চিত্কার করে পড়বার এমন কবিতা এদেশের তরুণরা যেন এই প্রথম হাতে পেয়েছিল। তাদের উদাস হৃদয়ের অস্থিরতারই এ যেন আশ্চর্য প্রতিধ্বনি। এ কবিতা যে সেদিন বাংলাদেশকে মাতিয়ে দেবে তাতে আশ্চর্য হবার কি আছে! [নজরুল সন্ধ্যা: নজরুল প্রসঙ্গে] কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লেখেন ঃ ‘এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্য বাণী? বাংলা সাহিত্য নয়, সমগ্র দেশ প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে উঠলো। এমনটি কোনোদিন শুনিনি, ভাবতেও পারিনি। যেন সমস্ত অনুপাতের বাইরে যেন সমস্ত অঙ্কপাত্রেরও অতিরিক্ত।... গদ গদ বিহ্বল দেশে এ কে এলো উচ্চণ্ড বজ্রনাদ হয়ে। আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ—আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাত্ উদ্দণ্ড মেরুদণ্ডে উঠে দাঁড়াল। [জ্যৈষ্ঠের ঝড়] আসলেই নজরুলের বিদ্রোহী সাধারণ একটি কবিতা মাত্র নয়। বিদ্রোহী মানুষের হাতে শব্দ দ্বারা নির্মিত গর্ব, অহঙ্কার, পৌরুষ ও শিল্পের সর্বোচ্চ মিনার। ১৩৯টি পঙিক্ত দ্বারা গেঁথে তোলা এ কবিতা বাংলা কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। মানুষ ও মানবতার সবচেয়ে বিশাল ও ঐশ্বর্যশালী সুরম্য ভবন। বাংলা কবিতা মাত্র একবারই সমুদ্রের ভয়াল গর্জন নিয়ে ফুঁসে উঠেছিল, মাত্র একবার বাংলা কবিতার মহিমাময় শির দেখে সম্ভ্রমে মাথা নুইয়ে দিয়েছিল হিমাদ্রীর শিখর,—আর তা বিদ্রোহীর মাধ্যমে। বাংলা কবিতার ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে দেহের ভিতরে যে এত তেজতপ্ত লাভা থাকতে পারে, ভাষা যে ডিনামাইটের মতো বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন হতে পারে, স্বর্গমর্ত্য টালমাটাল করা ভয়ঙ্কর গতিমান হতে পারে; হতে পারে দুর্দমনীয় দুঃসাহসী, হতে পারে বারুদ ও শিল্পের অনাস্বাদিত রসায়ন, নজরুলের জন্ম না হলে আমরা জানতে পারতাম না। তেমনই অবলীলায় বলা যায়, বিদ্রোহী রচনার পরদিন থেকে বিশ্বসাহিত্য ভাগ হয়ে যায় দু’ভাগে, একভাগ যারা বিদ্রোহী পড়েছে, অন্যভাগ যারা বিদ্রোহী পড়েনি। বিদ্রোহীর পতাকা হাতে নজরুলের আবির্ভাব না হলে বাংলা কবিতা আজও সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের ‘দালাল’ হয়েই থাকত। সে পূর্ণ ‘মানুষ’ হতো না। সে মুক্তিযুদ্ধ করতে পারত না। স্বাধীন হতে পারত না। মানুষ ও মানবতার জন্য বিদ্রোহীর চেয়ে বেশি করে বিশ্বসাহিত্যে কোথাও কিছু লেখা হয়নি। সেজন্য একক কবিতা হিসেবে বিদ্রোহী শুধু বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতা নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। দুই যে বিদ্রোহী কবিতা বাংলা কবিতায় নিয়ে এসেছিল অবিস্মরণীয় প্রভাত, সেই বিদ্রোহী কবিতা কিন্তু লেখা হয়েছিল ১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের এক রাতে। তপ্ত লাভার উদ্গীরণ ঘটেছিল হাড় কাঁপানো শীতে। নজরুলের কাছে সে সময় কোনো ফাউনটেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডুবিয়ে লিখতে হতো তাঁকে। বিদ্রোহী কবিতার প্রথম পাঠক কমরেড মুজাফফর আহমদ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।’ অর্থাত্ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতাটি কোনো কলম দিয়ে নয়, লেখা হয়েছিল পেন্সিলে, ৩/৪ তালতলা লেনের নিচের তলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরে, কলকাতায়। এই কবিতার দ্বিতীয় পাঠক ছিলেন, ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হক। তৃতীয় পাঠক ছিলেন ‘বিজলী’ পত্রিকার ম্যানেজার অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। প্রথম ছাপার কথা ছিল মোসলেম ভারতে। কিন্তু মোসলেম ভারত ছিল অনিয়মিত মাসিক পত্রিকা। সে জন্য অবিনাশ বাবুর দাবির মুখে আরেকটি কপি চলে যায় ‘বিজলী’তে। বিজলীই ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি প্রথম বারের মতো বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচন করে বিদ্রোহীর দ্বার। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বিদ্রোহী কবিতার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেছে চিরতরে। চিরতরে বললাম, কারণ ৯০ বছর পরও কেউই এর হদিস দিতে পারেনি। ৬ জানুয়ারির কলকাতা শহরের অবস্থা কেমন ছিল, তা আজ অনুমান করা কঠিন। কিন্তু স্মৃতিচারণে তার ছিটেফোঁটা পাই মাত্র। সেই ছিটেফোঁটা থেকে জানা যায়, সেদিন কলকাতার মোড়ে মোড়ে তরুণরা দলে দলে সমবেত হয়ে উচ্চকণ্ঠে আবৃত্তি করতে থাকে বিদ্রোহী। হঠাত্ যেন পাষাণপুরীতে ফিরে আসে প্রাণ। সড়কে সড়কে দেখা দেয় ট্রাফিক জ্যাম। বিজলী পত্রিকা দুই বার ছাপতে হয়েছিল সেদিন। দুইবারে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাপা হয়েছিল ২৯ হাজার। এটাও সে সময়কার বাংলায় একটা রেকর্ড। মুজাফফর আহমদের মতো সংযতবাক মানুষও স্বীকার করে গেছেন, সেদিন কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ বিদ্রোহী পড়েছিল। বিদ্রোহীর এই অভূতপূর্ব সাফল্যের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে মোসলেম ভারতসহ প্রবাসী, সাধনা, বসুমতী ও ধূমকেতু তা পুনর্মুদ্রণ করে। এ ঘটনাও বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়বার দেখা যায়নি। বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়ায় একে একে লেখা হতে থাকে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কবিতা। শ্রীমতি ইলামিত্র, সৈয়দ এমদাদ আলী, মোহিত লাল মজুমদার, সজনীকান্ত দাস, গোলাম মোস্তফা, হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন, নাজির আহমদ চৌধুরী, মোহাম্মদ আবদুল হাকিম, মোহাম্মদ গোলাম হোসেনসহ নাম জানা না জানা অনেকে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন। এর মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়া রক্ষণশীল অংশটি নামে বিরোধিতায়, আর যুবক তরুণসহ শিক্ষিত সম্প্রদায় বিদ্রোহীকে প্রাণের বাণী হিসেবে আত্মায় ধারণ করে জেগে ওঠেন। সামগ্রিক অর্থেই নজরুল জাতির সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন আলোকবর্তিকার মতো। সেটা যেমন রাজনৈতিকভাবে, তেমনি সাহিত্যিকভাবেও। তিনি এই দুই দিক থেকেই ছিলেন ত্রাণকর্তা। ক্রান্তিকালের নায়ক। তিনি আমাদের মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনারও প্রধান উদগাতা। ১৭৫৭ সালের পর বাংলাদেশ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটা ধারা হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সহযোগিতা, আপস ও দালালির ধারা। এই ধারার প্রধান কেন্দ্র ছিল কলকাতা। কলকাতার বণিক, মুত্সুদ্দি, কেরানীকুল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে উদ্ভূত ভূইফোঁড় চরিত্রহীন জমিদার শ্রেণী ছিল সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষার মূল শক্তি। অন্য ধারা ছিল মোকাবেলার ধারা, স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার ধারা। এই ধারা মীর কাসিমের পথ, ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের রক্তমাখা উত্তরাধিকার। নজরুল ছিলেন এই মোকাবেলার পথের শ্রেষ্ঠ উপহার। নজরুল যে রকমভাবে তাঁর অবমানিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, পরাধীন জাতির মর্ম ব্যথা অনুভব করেছিলেন—অন্যদের পক্ষে সেটা সঙ্গত কারণেই সম্ভব ছিল না। এজন্যই বলা যায়, বিদ্রোহীর মধ্যেও যেমন স্বর্গমর্ত্য পাতালের সবকিছু আছে, তেমনি আছে ১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তরের শহীদের রক্ত, আছে ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঘৃণা, আছে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের বারুদ, আছে আমাদের জাতিসত্তার ইতিহাস, আছে করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে পথ নির্দেশ। আবারও বলি বিদ্রোহী শুধুমাত্র একটি কবিতা নয়। বিদ্রোহী মানুষ ও মানবতার আইফেল টাওয়ার, ইতিহাসখ্যাত কুতুবমিনার, আমাদের লাখো শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে ওঠা আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। বিদ্রোহী মানে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বিদ্রোহী মানেই বাংলাদেশ। এক বিদ্রোহীর শব্দমালা হাতে নিয়েই বাংলাদেশ বিশ্বজয় করতে পারে। মনে রাখতে হবে, ইংল্যান্ডের জন্য যেমন শেক্সপীয়র, আমেরিকার জন্য যেমন হুইটম্যান, জাপানের যেমন নোগুচি, ইরানের যেমন ফেরদৌসী, নজরুল বাংলাদেশের জন্য তেমনি। নজরুল সত্যিকার অর্থেই আমাদের জাতীয় চেতনার মানবীয় প্রতিকৃতি। - কবি আ ব দু ল হা ই শি ক দা র দৈনিক আমারদেশ, সাহিত্য-সাময়িকী, ২৩.১২.২০১১ইং। (এই অনুচ্ছেদটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)।’’
আমাদের বর্তমান কবিদের কাছ থেকে পেতে চাই এই ধরণের চিত্ত জাগানিয়া বিদ্রোহী ও জাগরণের কবিতা -
" বিদ্রোহী কবিতা
বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!
আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দেই তিন দোল্;
আমি চপোলা-চপোল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরীত্রির;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর।
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চির-দূরন্ত দুর্মদ
আমি দূর্দম মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্ হ্যায় হর্দম্ ভরপুর্ মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ঈন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য;
আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!
আমি সন্ন্যাসী, সুর সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ।
আমি বজ্র, আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশুল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র-মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, -আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস
আমি মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, -কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল ঊর্মির হিন্দোল-দোল!-
আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী, তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন, মন-উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষূব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যাথা সূনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তাঁর কাঁকণ-চুড়ির কন্-কন্।
আমি চির শিশু, চির কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচুলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন,
আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালী দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোর্রাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রী, বাড়ব বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল, অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া, উড়ে চলি জোড় তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারি’ ভুবনে সহসা, সঞ্চারি ভূমিকম্প।
ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’-
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।
আমি দেবশিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্ঘুম্
ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’।
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠি’ ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
============
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন