আনসারদের ঐ বসতিতে ছিল এক উশৃন্খল যুবতীর বাস। রূপে গুণে ছিল সে অনন্যা। কিন্তু, নিজ ইজ্জত আবরুর দিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপই ছিলনা। সর্বদা সে উদাসী, অশ্লীল ও উশৃন্খলভাবে যত্রতত্র চলাফেরা করত। বেপর্দায় উদ্ভাসিত ছিল তার উশৃন্খল জীবন। হঠাৎ একদিন যুবতীটি খলিফার দরবারে উগ্রবেশে গিয়ে উপস্থিত হল। খলিফার দরবর তখন লোকে লোকারণ্য। আমীর-ওমরাগণ নিজ নিজ আসনে সমাসীন।
যুবতীটির ফরিয়াদ প্রকাশের নির্দেশ দিলেন খলিফা। যুবতীটি কালবিলম্ব না করেই চিৎকার করে জানাতে শুরু করল তার ফরিয়াদ - “ আমীরুল মু’মেনীন ! এক আনসারী যুবক আমার ক্ষতি করেছে। আমার সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। আমার সঙ্গে জোর করে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করেছে। এই দেখুন তার কুকর্মের নিদর্শন’’- এই বলেই যুবতীটি পর্দালঙ্গন করে তার একটি নিদ্রিষ্ট অঙ্গের দিকে ইশারা করল !
সভাসদবর্গের সকলে হতবাক ! নিস্তব্ধ খেলাফত মজলিস। আমীরুল মু’মেনীন উদ্ধিগ্ন। উপস্থিত সকলেই পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলেন। কার কোন শব্দ নেই। যুবতীটি দাঁড়িয়ে। মনের মাঝে সৃষ্টি হলো তার খুশির ফোয়ারা। হাস্যোজ্জ্বল তার মুখাবয়ব।
আমীরুল মু’মেনীন প্রমাণের ভিত্তিতে যুবকটিকে অপরাধী সাব্যস্ত করলেন। আনসার যুবকটিকে দরবারে ডেকে আনা হল।বিচারের কাঠগড়ায় উপনীত হল যুবকটি। সুদর্শন, লাজুক চেহারা ও সভ্য স্বভাবের নিষ্পাপ যুবকটির চতুর্দশী চাঁদের মত উজ্জ্বল প্রভাকর রূশনীতে আলোকিত হয়ে গেল খলিফার দরবার কক্ষ। কারো কাছেই বিশ্বাস হচ্ছেনা এ যুবক তেমন একটা গর্হিত কর্মে জড়িত হতে পারে !
যুবকটি দরবারের অভ্যান্তরে পা’ রেখে খলিফার দিকে তাকিয়ে সকলের প্রতি সালাম প্রদান করল। তারপর অবনত মস্তকে জিজ্ঞেস করল খলিফার কাছে , কেন তাকে দরবারে ডেকে আনা হয়েছে ? তারপর চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। খলিফা যুবকের দিকে দৃষ্টি রাখলেন। অগ্নিশর্মা খলিফার চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আদেশ দিলেন যুবকটির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তাকে শুনানোর জন্য। যুবতীটির অভিযোগ তাকে শুনানো হল।
খলিফা কর্তৃক তার উপর শাস্তির বিধান জারী করা হল। এমতাবস্থায় যুবকটি কি করবে ভেবে পাচ্ছিলনা। সে কাতরকন্ঠে বলতে লাগল – “ হে আমীরুল মু’মেনীন ! আপনি আমার দিকে কটু মহত্বের দৃষ্টি দিন। আমার বিষয়ে একটু ভাবুন। মহান আল্লাহর কসম ! আমি মোটেও কখনো অশ্লীল পথে পা’ বাড়াইনি। জীবনে এ পর্যন্ত কোন বেগানা নারীর দিকে চোখ তুলে তাকাইনি। মহানুভব ! যুবতীটির কাছে গমনতো আমার পক্ষে মোটেই সম্ভবপর ছিলনা। ঐ নারী আমার বিরূদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র করেছে। আমি নিজে আমার আত্মপক্ষে আমার নির্দোষীতার আর্জি পেশ করছি”।
যুবকটির আর্জি শুনে সভাসদগণ সকলেই আশ্চর্যাম্বিত ! খলিফা তার আর্জি শুনে বিব্রত হয়ে পড়লেন। ভেবে পাচ্ছেননা তিনি কি করবেন ? কিভাবে বিচারের রায় দিবেন বুঝতে পারছেননা। এক সংকটময় সমষ্যার বেড়াজালে বন্ধী সবাই। অথচ প্রমাণসর্বস্ব অভিযোগ নিয়ে দণ্ডায়মান। সময় ক্ষ্যাপনের পরিস্থিতি নেই। একটা কিছু করতেই হবে।
আমীরুল মু’মেনীন হযরত আলী (রাঃ) কে লক্ষ্য করে বললেন – “ হে আবুল হাসান ! এ বিষয়ে আপনার মতামত ব্যক্ত করুন’’। হযরত আলী (রাঃ) কিছুণ নীরব ও স্থীর থাকলেন। ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর মেয়েটির কাপড় তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর কিছু গরম পানি আনার নির্দেশ দিলেন। গরম পানি আনা হল। গরমপানি যুবতীটির কাপড়ে লেগে থাকা প্রমাণের উপর ঢালতে নির্দেশ দিলেন তিনি। কাপড়ে গরম পানি ঢালা হল। গরমপানি লেগে কাপড়ে লেগে থাকা সফেদ জিনিসটি জমাটবদ্ধ হয়ে গেল। হযরত আলী (রাঃ) প্রমাণটি হাতে নিয়ে ঘ্রাণ নিলেন নাক দিয়ে। আস্বাদন করে দেখলেন যে, জিনিসটি আসলেই ডিম। রহস্য উদঘাটিত হল। যুবতীটিকে তিনি মিথ্যা অভিযোগকারিনী হিসেবে অভিযুক্ত করলেন।
যুবতীটি তার ষঢ়যন্ত্রের কথা স্বীকার করে বলতে লাগল – “ আমীরুল মু’মেনীন ! আমি যুবকটির পাশের বাড়ীতে থাকি। একদিন যুবকটি আমার নজরে আসলে তাকে আমার ভাল লেগে যায়। অনেকদিন আগে থেকে তাকে আমি মনে মনে ভালবাসতে শুরু করি। আমার একপক্ষীয় ভালবাসা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তাকে আমি অনকবার কাছে পাবার চেষ্ঠা করি। কিন্তু অনেক চেষ্ঠার পরও যুবকটির কোন সাড়া মেলেনি। তাই তাকে ফাঁদে ফেলানোর জন্য বিভিন্ন ভাবে চিন্তা করতে থাকি। অবশেষে এ বুদ্ধিটা আমার মাথায় আসে। তাই, ডিম নিয়ে তার কুসুম ফেলে দিই। তারপর ডিমের সাদা অংশটুকু আমার রানদ্বয়ে এবং কাপড়ে মেখে নিই। তারপর তড়িৎ গতিতে উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়ে খলিফার দরবারে উপস্থিত হই। অভিযোগ করি যুবকটির বিরুদ্ধে। এইভাবে মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে যুবকটিকে কাছে পাবার শেষ চেষ্ঠা চালাই। মনে করেছিলাম এই অভিযোগই তাকে আমার কাছে টেনে আনবে।
এভাবেই মিথ্যা অভিযোগকারীরা পদে পদে লাঞ্চিত হয় আর সৎ মানুষরা তাদের সততার গুণ দিয়ে মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে মুক্তি লাভ করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন