[বিঃদ্রঃ - এ লেখাটি উৎসর্গ করছি মীরপুর ঢাকার সেই ফারহানাকে (যার ছদ্ধনাম ছিল আজমুন্নাহার) – যে ২০ বছর আগে এ লেখাটি পড়ে পাঠিয়েছিল নিজ হাতে বানানো কাপড়ের একটা লালগোলাপ।
এ লেখাটি “সাপ্তাহিক দেশচিত্রের” ২৩–২৯ নভেম্বর – ১৯৯২ইং ১ম বর্ষ , ৪৯ সংখ্যা এবং একই সময়ের “অপরাধচিত্র” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত হয়েছে দেখলাম আজই একটি ব্লগে-(http://dsore.blogspot.com/2011/10/blog-post_29.html)। এটি কিছুটা সংশোধন করে পুনরায় প্রকাশ করা হলো।]
*******************
জীবনযুদ্ধে আজ আমি এক পরাজিত সৈনিক। সকলের ঘৃণার পাত্র। সকলের কাছে আজ আমি এক অবাঞ্চিত ছেলে। সকলের খেলনার পুতুল। সকলের ষড়যন্ত্রে নিষ্পেষিত সমাজের এক দুষ্টগ্রহ। সমাজের কাছে চক্ষুসুল এক ব্যক্তি। পিতার নিরাদর, মায়ের মমতাহীনতা , ভাই-বোনদের অবজ্ঞা , ভাবীদের ঘৃণা , বন্ধুদের ষড়যন্ত্র , বান্ধবীদের প্রতারণা , শুভাকান্খীদের ছলনা , প্রতিবেশীদের তীরস্কার , সমাজের লাঞ্চনা , গ্রামের হেয়কার , দশের বাহির , দেশের গণনাহীনতায় আজ আমি অসহায়। ভীষণ পিপাসার্ত আমি। হৃদয় আমার জর্জরিত , শরীরের তাবৎ গীটগুলো লালাহীন। প্রতিটি শিরা-উপশিরায় ব্যর্থতার ছাপ সুস্পষ্ট। আত্মগ্লানীতে সমগ্র শরীর আজ বিষাদময় কন্টকে আবৃত।
আজ আমাকে দেখলেই পিতার স্নেহ জাগে স্বকরুন ভাবাবেগে। মায়ের মমতা নাড়া দেয় তার হৃদয়খণির অবাঞ্চিত স্থান থেকে। ভাই-বোনদের অবজ্ঞা তাদের কপালের উপর প্রকাশ ঘটে। ভাবীদের ঘৃণা প্রস্ফুটিত হয় লাল গোলাপের ন্যায়। বন্ধুদের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হয় আপাদমস্তক। বান্ধবীরা প্রতারণা করতে সুযোগ খুঁজে। শুভাকান্খীদের ছলনা ধারণ করে তীব্রবেগ। প্রতিবেশীরা উদ্যত হয় তিরস্কারে। সমাজ দান করে লাঞ্চনা। গ্রামবাসী হেয় মনে করে। দশজনের বাইরে পাতা হয় আমার আসন। দেশের আদমশুারীতে রাখা হয় আমায় গণনার বাহিরে।
আজ আমাকে দেখলেই ভাবীরা শব্দ করে ঘরের কপাট বন্ধ করে ছুঁড়ে ঘৃণার তীর। বোনেরা ধরে অপরিচিত রূপ। ভাগ্নে-ভাগ্নিরা মামা বলে স্বীকার করতে কষ্ট অনুভব করে। চাচা-চাচী ভিন্ন চোখে জরিপ করে। ভাতিজা-ভাতিজী চাচা বলতে সংকোচবোধ করে। আত্মীয়-স্বজন পরিচয় গোপন করে মুখ ফিরায়। প্রিয়জন করে মুখের উপর থুথু নিক্ষেপ। প্রেমিকা প্রেমের প্রতিদান চায় সম্পদের জয়কারে। ছাত্রবন্ধু চায় পকেটে টাকার ভাঁজ। শিক্ষক চায় প্রাইভেট পড়ানোর নামে টাকা উপার্জনের সুযোগ।
কিন্তু আমাকে কেউ চায়না। চায় আমার কাছ থেকে হাসিল করে নিতে যার যার উদ্দেশ্য। এটাই আমার বিগত জীবনের চাওয়া , পাওয়া আর অভিজ্ঞতা। তীক্ষ্ন অথচ ক্ষুদ্র , কম অথচ বিস্তর পরীক্ষার আয়োজন করে সকলের কাছ থেকে আমি এতটুকু সম্পদই সঞ্চয় করতে পেরেছি। এখন আমার এটাই একমাত্র সঞ্চিত ধন।
তবে যদি আমি প্রত্যেক বিষয়ে পাহাড়ের মত অটল আর নদীর স্রোতের মত গতিময় হতে পারতাম , যদি পারতাম বজ্রের ন্যায় হুন্কার ছাড়তে , হাতীর ন্যায় শরীর গড়তে , বাচালের ন্যায় বক বক করতে , রাক্ষসের ন্যায় ভক্ষণ করতে , বাঁদরেরে ন্যায় যত্রতত্র থাবা মারতে , নির্লজ্জের ন্যায় বেহায়া কথা বলতে , অভদ্রের ন্যায় গর্জিয়ে কথা বলতে , ভিখারীর প্রসারিত হাতকে লাথ্থি মেরে গুড়িয়ে দিতে , ভুখাদের কুড়ানো অন্নের থালা দরোজা বন্ধর ছলে ধাকা মেরে ছিটিয়ে ফেলে দিতে , অসহায়দের পাতানো হাতে থুথু দিতে , এতিমদের তাবৎ সম্পত্তি ভোগ করতে , অন্নের ঘাম ঝরানো সম্পদ জবর দখল করে নিজের অধিকারে নিয়ে আসতে – তবে হয়তো প্রতিষ্ঠা পেতাম সমাজের একজন আদরনীয় ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব হিসাবে , বসার সুযোগ পেতাম সমাজের প্রতিটি স্তরে , নাম লেখাতে পারতাম বর্তমান মুখোশধারী ভদ্দরনোকদের মত সুশীল সমাজে (?) এর মানুষদের কাতারে , রাষ্ট্রীয় গণনায় দেশের নাগরিক হিসাবে পরিচিত হতে পারতাম। পারতাম উঁচুতলার মানুষদের জলসায় শামীল হতে , হতে পারতাম গ্রাম বা দেশবাসীর মাথার মুকুট ।
আজ আমি হয়েছি জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক। জীবনটা তাই আজ হয়েছে বড়ই দূর্বীসহ। আমি এই দূর্বীসহ সৈনিক জীবন থেকে মুক্তি চাই। চাই নির্মল ও সুস্থ সমাজের একজন সদস্য হতে।====================