আজ রান্না করেছিলাম সীমের বিচির সাথে কইমাছ । মাছ খেতে গিয়ে পেলাম হাতে কাঁটার আঘাত । এসে গেল মনে সেই ছোট্ট বয়সের স্মৃতি । থমকে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য । হারিয়ে গেলাম শৈশবে । জলধারা নেমে এল চোখে । সিক্ত হল নয়নযুগল ।
আমার পার্টনার লক্ষ্য করল আমাকে । কি হয়েছে জানতে চাইল । বললাম – কিছুইনা । বারবার তাগাদায় তাকে শেয়ার করলাম শৈশবের সেই মধুর স্মৃতি ।
মাছ খেতে চাইতামনা কাঁটার ভয়ে সেই শৈশবে । একদিন দুপুরে মাছ রান্না হলো ঘরে । খেতে বসলাম সব ভাইবোন । বড় বোন খানা পরিবেষন করছিল । সবার মত আমার প্লেটেও মাছ দিতে চাইল সে । বাঁধ সাধলাম আমি ।
মাছ আমি খাব না । বড়বোন নাছোড়বান্দা । মাছ আমাকে খেতেই হবে । খুবই আদর করে বলল – ভয় নেই , আমি মাছ বেছে দিচ্ছি , তুই খেতে থাক । বোনটি তখন মাছের টুকরাটা বেছে বেছে আমার প্লেটের উপরিভাগের কার্নিশের চারিধারে ছোট ছোট খন্ডে রাখতে লাগল , আর আমি সেখান থেকে এক এক করে নিয়ে ভাতের সাথে মিশিয়ে খেতে থাকলাম । বোনের ভালবাসায় সেদিন বোনের সহযোগীতায় মাছ দিয়ে ভাত খেতে পারলাম । আমার যতক্ষণ খানা শেষ হয়নি ততক্ষণই বোনের নজর ছিল আমার দিকে ।
সেদিনের সেই স্মৃতি আজ ৩৫/৪০ বছর পর হঠাৎই যেন মনে ধাক্কা খেল । ছোট ভাইয়ের প্রতি বড় বোনের স্নেহ ও মমত্ববোধ , ভালবাসার স্মৃতি আজ আমাকে নিয়ে গেল ভালবাসার সেই পরিমন্ডলে । যেখানে ছিল আমাদের এক সুখী পরিবার । যেখানে ছিলাম আমরা সকল ভাই-বোন ভালবাসায় বন্দী । যেখানে আমরা ভালবাসায় সিক্ত হয়ে শান্তির ফোয়ারায় অবগাহন করতাম ।
জীবনের তেতাল্লিশটি বছর পেরিয়ে আজ আবার হারিয়ে গেলাম সেই ভালবাসার ভুবনে । যদিও নেই আজ সেই ভালবাসার ভুবন । নেই আজ সেই ভালবাসা । নেই আজ সেই ভালবাসার বন্ধন । হারিয়ে গেছে সব কালের গর্ভে । জীবনের নানাবিদ সমস্যার ধ্বংসযজ্ঞে ।
সবাই এখন যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত । সৃষ্টি হয়েছে সকলের ভিন্ন ভিন্ন ভালবাসার ভুবন । হয়ে গেছি কাছের মানুষরা দূরের , আর দূরের মানুষরা কাছের । ভুলে গেছি একে অপরকে । ভুলে গেছি সেই সুবর্ণ বন্ধন । ভুলে গেছি সেইসব ভালবাসার মধুর ক্ষণ । যে ভাই-বোন একসাথে খেতাম , একসাথে শুইতাম , একসাথে খেলতাম , সেই ভাই-বোনের আজ খানা চলছে পৃথক – অদেখায় , শোয়া চলছে লক্ষ যোজন দূরে , জীবনের খেলা চলছে পৃথক পৃথক খেলার ঘরে ।
ভাবনা আসে মনে – যদি বড় না হয়ে ছোট থাকতাম , কতই না ভাল হত । থাকতে পারতাম সবাই একসাথে । হাসি – খুশি – আনন্দে কতইনা সুখে দিন কাটাতে পারতাম । কেন যে বড় হলাম ? বঞ্চিত হয়েছি সকলের ভালবাসা থেকে । সরে গেছি দূরে , বহুদুরে ।
হায়রে বোন আমার ! সেই বোনের সে শরীর আর নেই , সেই চঞ্চলতা আর নেই । সেই দৃষ্টি আর নেই । নেই তার সেই হাসি , নেই সেই খুশি , নেই সেই উচ্ছলতা । সেই শক্তি তার আর নেই , সেই মেঝাজ আর নেই , সেই চিন্তা আর নেই – নুয়ে পড়েছে শরীরের ভার বয়সের ভারে , ধ্বংস হয়েছে বিভিন্ন চিন্তায় – সাংসারিক যাতাকলে ।
দেখলে মনে হয় – এ তো আমার বোন নয় । আমার বোন এমন ছিলনা । আমার বোনের ছিল - আমাকে মারার শক্তি , আমাকে শাসন করার ক্ষমতা , আমাকে নিয়ে চিন্তা করার মাথাব্যথা , আমাকে আদর-স্নেহ-ভালবাসায় কাছে টেনে জড়িয়ে ধরার আকুলতা ।
বোনের সেই ভালবাসা থেকে বঞ্চিত আমি আজ তার সেই ভালোবাসা, সেই স্নেহ , সেই আদর , সেই মমতা খুঁজি – খাবার প্লেটে , বিছানা পাততে গিয়ে , কাপড় গায়ে দিতে গিয়ে , প্যান্ট পরতে গিয়ে , গেঞ্জী গায়ে দেবার সময় , মুখ ধুইতে গেলে , দাঁত ব্রাশ করার সময় , টেবিলে খেতে বসে , মাছ খাবার সময় ।
বড়বোনকে বুবু বলেই ডাকতাম , এখনও তাই । আজও বুবু বলেই তাকে স্মরণ করছি । বুবু ! বড় হয়ে আমি হয়ে গেছি তোমাদের পর । তবু ভুলি নাই তোমার সেইসব মমতাকাতর ভালবাসার ছবি । কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই ভালবাসা যদিও , ধরে রেখেছি মনের কোণে তোমার ভালোবাসা , তোমার আদর , তোমার স্নেহ , তোমার মমতা। তুমি যত দূরেই রওনা কেন , এভবেই চেয়ে নেব তোমার ভালবাসার ছোঁয়া । এভাবেই মনের অলিন্দে বয়ে বেড়াব তোমার ভালোবাসা , তোমার আদর , তোমার স্নেহ , তোমার মমতা। জীবনবধি ধরে রাখব তোমার ভালবাসার স্মৃতি বুকের গভীরে ।
=============