সমবায় কি বা সমবায়ের পরিচয় ঃ
সমবায় শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ - মিলন ,নিত্য সম্বন্ধ, একত্র হবার বুদ্ধি ও প্রয়াস, সমবেত বা যৌথ কর্মপ্রচেষ্ঠা। ইংরেজীতে যা CO-OPERATIVE নামে অভিহীত। সমবায় অর্থ হলো – আত্মসাহায্য ও পারস্পরিক সহযোগীতা।
ব্যাপক অর্থে সমবায় হচ্ছে – একাধিক লোকের শতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে গঠিত ও পরিচালিত একটা কর্মপ্রচেষ্ঠা। সমশ্রেনী বা সমপেশাভুক্ত সকলের সাবলম্বী হবার একটা উত্তম পন্থা ও মহৎ প্রেরণা। সর্বোপরী সমবায় হলো – একটা আন্দোলন।
প্রতিটি মানুষের একটা জন্মগত বৈশিষ্ঠ যে , সে সাংগঠনিক জীবন চায়। চায় একটা স্বীকৃতি। কিছু মানুষের সম্মিলিত সহাবস্থানে সৃষ্ঠ তেমনই একটি সাংগঠনিক জীবন ও স্বীকৃতির নাম সমবায়।
এক সমবায়ী বলেছিলেন – “Co-operative , this is a various business. It’s not a package program but it’s a long term practice – অর্থাৎ সমবায়, ইহা একটি বাস্তব ভিত্তিক ব্যবসা। ইহা গাঁটবাধা কোন কর্মসুচী নয়, কিন্তু ইহা একটা দীর্ঘায়িত অনুশীলন”।
Co-operation বা সহযোগীতা কথাটা থেকেই Co-operative বা সমবায় কথাটার জন্ম। সমবায় হলো – পরস্পরের সহযোগীতায় পরস্পরের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা দূর করার একটা উপায়।
সাম্য – ঐক্য – সততার সমন্বয়ে সৃষ্ট একটা জোটই হলো সমবায়। সমবায় একটি আচরণ বিজ্ঞান। একক প্রচেষ্ঠা যেখানে ব্যর্থ সেখানেই প্রয়োজন দলগত প্রচেষ্ঠা। সমন্বিত প্রচেষ্ঠায়ই আনতে পারে আশাতীত সাফল্য। একটা চিন্তা একজনে না করে বহুজনের মধ্যে যদি সেটা বিস্তার ঘটানো যায় তবে এর কাটামো থেকে চূড়ান্ত অবস্থাবধি আমুল পরিবর্তন সম্ভব। চূড়ান্ত অবস্থায় আমুল পরিবর্তন আনায়নে আশাতীত সাফল্য লাভের লক্ষ্যে সমন্বিত এক প্রচেষ্ঠার নামই সমবায়।
সমবায় মানে আত্মসাহায্য ও পারস্পরিক সহযোগীতা। সমবায় সংগঠন একটি আইনগত স্বতন্ত্র ও কৃত্রিম স্বত্তা। সমবায় সাংবিধানিক মালিকানার দ্বিতীয় সেক্টর। সমবায় একটা সুশৃন্খল ও গণতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক সংগঠন।
সমবায় একটি সামাজিক অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা। সমবায় হলো সমাজতন্ত্রের জন্য একটা পরিপূর্ণ প্রস্তুতি। সমবায় হলো লক্ষ লক্ষ কৃষক সাধারণের কাছে ক্ষুদ্র খোদকস্থ জোত থেকে বৃহৎ যৌথ অর্থনীতিতে উত্তরণের সবচেয়ে সহজ-সরল আয়ত্বাধীন একটা পথ। সমবায় কৃষকদের এক একটা বাহিনী বা স্তরকে নয়, সমগ্র গরীব - মাঝারী জোতগুলোকে মেলাবার একটা পথ। কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – “ অনেক গৃহস্থ , অনেক মানুষ একজোট হইয়া জীবিকা নির্বাহ করিবার যে উপায়, তাহাকেই ইউরোপে আজকাল Co-operative প্রণালী আর বাংলায় সমবায় প্রণালী নাম দেওয়া হইয়াছে”।
সমবায় হলো পূঁজিবাদী সমাজের একমাত্র যন্ত্র – নতুন ক্ষমতা যাকে চূর্ণ করেনা , টিকিয়ে রাখে , ঢেলে সাজায় , বিকশিত ও সম্পূর্ণ করে, গণসংগঠন হিসাবে গণউদ্যোগকে প্রণোদিত করে, দেশকে খাদ্য জোগাতে সাহায্য করে, সাহায্য করে নতুন ক্ষমতাকে।
সমবায় হলো একটা আদর্শ, একটা দর্শন ও একটা অর্থনৈতিক কাজের পদ্ধতি। সমবায় হলো সাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে একটা ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রয়াস। দশে মিলে সুনিদ্রিষ্ট নীতিমালা ও আদর্শের ভিত্তিতে কাজ করাই হচ্ছে সমবায়ের মূল দর্শন।
সমবায় সংগঠন হচ্ছে – সংগবদ্ধ অর্থনৈতিক কাজের একটি পরিশৃন্খল রূপ। জনসাধারণের আর্থসামজিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে একটি সুশৃন্খল মানবসংগঠন হচ্ছে সমবায়। সমবায় স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর একটা সংগঠন। সমবায় একটি Concept বা ধারণা, একটা Movement বা অবস্থান পরিবর্তনের আন্দোলন।
মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে অমুলক ধারণাক পাল্টে উন্নতর কিছু ধারণা , মতাদর্শ দান এবং সত্যিকার ও অর্থবহভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থেই সমবায়। অনেক মানুষ একজোট হয়ে জীবিকা নির্বাহ করার যে উপায় , তাই উন্নত দেশের Co-operative বা সমবায় প্রণালী। যা আমাদের দেশকে দারিদ্রতা থেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায়। তাই, দেশের দারিদ্রতা দূরীকরনের জন্যই সমবায়। একের নয় , সমষ্ঠগত উন্নয়নের জন্যই সমবায়। কতক নয় , বহু মানুষের কল্যানের জন্যই সমবায়। সমবায় উত্তরণের জন্য, স্বপ্নলোকের রাজ্য জয়ের জন্যই সমবায়। টেকসই করার লাগসই প্রযুক্তিই হচ্ছে সমবায়। সমবায় হচ্ছে – সমমনা মানুষদের একত্রিত চিন্তা ও সম্ভাবনাময় বহুমুখী কার্যক্রমের আত্মপ্রকাশ।
জীবন যাত্রাপথে স্বচ্ছতা আনায়নে কিছু উদ্যোগী মানুষ সমমনা হয়ে একই ঘরের সদস্য স্বরূপ একই ঘরে অবস্থানের মত সহাবস্থানের একটি জোট গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করে সামান্য পূজি ধাপে ধাপেএকটা পাত্রে সঞ্চয়ের মাধ্যমে একে অপরকে সহযোগীতা দান এবং একে অপরের কল্যান চাওয়ার নামই হচ্ছে সমবায়।
সবশেষে , সমবায়ের পরিচয় দিতে গিয়ে বলতে হয় –
সমবায়
একক বলয়ে সময় কাটিয়ে
এনেছে জীবনে গ্লানী।
যেদিন থেকেই জেনেছে মানুষ
সামাজক জীব তারা,
সেদিন থেকেই মানুষ জাতি
মেনে নিল সমাজ গঠনের ধারা।
সমাজবদ্ধ হয়ে যখন মানুষ জাতি
করলো আত্মপ্রকাশ ,
চতুর্দিকেই দেখা দিলো
গৌরান্বিত সভ্যতার ক্রমবিকাশ!
একাত্বতার দিকবলয়ে
প্রবেশ করে মানুষ
দূর করে সেই একাকীত্বের গ্লানী ,
ফিরে পায় হুঁশ।
পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে
মুলে ছিল তা একতায় নির্ভর -
একতা – এই একটি মাত্রই মত,
যুগে যুগে বিশ্ব নবরূপ নিয়েছে –
হয়েছ সবে স্বনির্ভর ;
মুলে ছিল তার – যুবদের খুনরাঙ্গা পথ।
পৃথিবীতে যা কিছু বৃহৎ সৃষ্টি –
মূলে ছিল তার ছোট্ট ছোট্ট বিষয় ,
দেখো ! ব্যাংকের ঐ বিশাল টাকার স্তুপ –
সেতো বহু মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়।
যুগে যুগে মানুষ হয়েছে একতা ,
সংগঠন করে দেখিয়েছে সমতা ;
প্রগতির ধারাকে রেখেছে বহতা ,
দেখিয়েছে মানুষ নিজেদের ক্ষমতা।
যুগে যুগে মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ,
পাল্টিয়েছে পৃথিবীর শোভা ;
বহু মানুষের ভিন্ন মত ঐক্য হেছে,
সমবায় গড়ে করেছে মানুষকে মনোলোভা।
**********************
সকলের জন্যই সকল মানুষ
অনন্তের পথে ধীরে ধীরে যাচ্ছে তাহা গন্তব্যে চলে ।
আপন আপন জীবন নিয়ে ব্যস্ত মানুষ পুরু জীবন ভরি ,
মানবতার মৃত্যু হচ্ছে আজ মানুষের ব্যস্ততার চাপে পড়ি !
সৃষ্টির সেরা মানবজাতির নহে নহে ইহা ধর্ম ,
মানুষতো এসেছে পৃথিবীতে দেখাতে মানবতার কর্ম ।
মানবজীবন নয়তো শুধুই আপনারে নিয়ে বিব্রত রহিতে ,
সকলের জন্যই সকল মানুষ লিখেছে মানবধর্ম বহিতে ।
=======================
সমবায়ের সংজ্ঞা ঃ
বিভিন্ন দার্শনিক , চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে সমবায় বিভিন্ন রূপে ধরা দিয়ছে । সমবায়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে কালবার্ট বলেন – “ কোন সংগঠনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত আত্মসাহায্যের নামই সমবায় ।
সি এফ ষ্ট্রিকল্যাণ্ড সমবায়ের সংজ্ঞা দেন এভাবে – “কতিপয় ব্যক্তির যৌথ উদ্যোগে বিশেষ একটি লক্ষ্যে উপণিত হবার উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি আন্দোলন, যা কারো একক প্রচেষ্ঠায় সাধন সম্ভব নয়, তাই সমবায়”।
স্যার এম এল ডালিং সমবায়ের সংজ্ঞা যেটি দেন , তা হলো – “ সমশ্রেণী বা পেশাভুক্ত কিছু লোক একে অন্যের সাহায্যে নিজেদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য সংস্থা গঠন করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তা পরিচালনা করা। সমবায় হচ্ছে একটি ধর্ম যা ব্যবসায়ে প্রয়োগ করা হয়।
সমবায়ের লক্ষ্য ঃ
সকলের সার্বিক মঙ্গল ও সুখী জীবনের নিশ্চয়তা বিধানই সমবায়ের লক্ষ্য।
সমবায়ের উদ্দেশ্য ঃ
মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সমাজ থেকে বিতাড়ন করা , শোষকদের কাছ থেকে দরিদ্র ও স্বল্পভিত্বদের মুক্তি পেতে সাহায্য প্রদান করা, উন্নত সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, উন্নত কৃষি ব্যবস্থার ও ঋণের বোঝার মুক্তি দান করা, ন্যায্য মু্ল্য পাবার ব্যবস্থ করা ও ন্যায্য মুল্যে ভোগপণ্য বিক্রি করাই হলো সমবায়ের উদ্দেশ্য ।
সমবায়ের বৈশিষ্ঠ্য ঃ
একক প্রচেষ্ঠা যেখানে ব্যর্থ সমবায় সেখানে যে কোন জটিল ও বড় কাজ সম্পাদনে সক্ষম।পূঁজি গঠনে , নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনে সমবায় মানুষকে সংঘবদ্ধ করে সুশৃন্খল ও শক্তিশালী করে তোলে। ব্যবহারকারীর স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য সমবায় উৎপাদনকারীকে তার উৎপাদনে সর্বাদিক প্রতিষ্ঠার সুযোগ প্রদান করে।
যেহেতু সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সদস্যগণ গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুত করতে পারে , সেহেতু সমবায় মানুষের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠান বটে। যেহেতু সমবায় প্রচেষ্ঠায় মানুষ তাদের শক্তি সঞ্চয় করে পূঁজি গঠন করতে পারে এবং শ্রমজীবি মানুষেরা সমবায়ের মাধ্যমে বাঁচতে পারে, সেহেতু শ্রমজীবি মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠায় ও তাদের জীবন মান উন্নয়নের একটি প্রতিষ্ঠান।
সমবায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অব্যাহত সম্পদকে উৎপাদনমুখী সম্পদে রূপান্তর করা যায়। সমবায় দেশের ধন সম্পদ গুটিকতক মানুষের হাতে পুঞ্জীভুত হওয়া থেকে মুক্ত করে এবং সম্পদকে পরিব্যপ্ত করে। উন্নত ব্যবসা , উন্নত চাষাবাদ ও উন্নত জীবনযাত্রায় সমবায় একটি পরীক্ষিত উপায়।
সমবায়ের গুরুত্ব ঃ
সমবায় সাধারণ মানুষকে বিশেষকরে কৃষক ও শ্রমজীবি মানুষদেরকে একটি সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ করে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এক গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পান করে, শেয়ার ও সঞ্চয় সংগ্রহ করে তাদের পূঁজি গঠনে সাহায্য করে। মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য এবং তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনায়নের জন্য সাহায্য হিসাবে উৎপাদন কাজে তাদের শ্রম ও পূঁজি বিনিয়োগের পথ সুগম করে। তাই সমবায়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
সমবায়ের প্রয়োজনীয়তা ঃ
দরিদ্র ও অশিক্ষিত লোকের ক্ষুদ্র শক্তিকে একত্রিত করে একটি অর্থবহ উৎপাদন সক্ষম দল প্রতিষ্ঠিত করার উপায় হচ্ছে সমবায়। অথচ এ ধরণের সংগঠনের অভাবে এদের শক্তিকে কাজে লাগানো যাচ্ছনা। এদের প্রত্যেকের আর্থিক সম্পদ এত কম যে একক প্রচেষ্টায় কোন আর্থিক উৎপাদন কর্ম পরিচালনা করা এদের পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন তাদের কর্মসংস্থানে সম্পদ সৃষ্টি ও উৎপাদনে এবংসম্পদের সুষম বন্টনে সমবায় দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন ও বন্টন প্রক্রিয়ায় সমবায়ী তৎপরতা একটি অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বিধায় এদেশে তথা যে কোন দরিদ্র দেশে সমবায় একটি অতি উপযোগী ও প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান।
==============
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন