আমার লেখালেখির অন্তরালে ...
( পর্ব - ২ )
মুহাম্মদ জাকারিয়া শাহনগরী
--------------------------------
অপেশাদার লেখকরা নিরন্তর লেখার সাধনা করেন । কিন্তু তাঁরা নিজেদের লেখার পরিচয় তুলে ধরতে পারেনা মানব সমাজে । তাই , তাঁরা পরিচিতি পান না - কবি - সাহিত্যিক রূপে । যাঁরা পরিচয় তুলে ধরতে ভয় পান বা লজ্জা পান , তাঁদের লেখাগুলো পড়ে থাকে তাঁদের ঘরের টেবিলে । নিজেদের লেখা তাঁরা নিজেরাই পড়ে পড়ে আনন্দ পান । অথচ , তাঁদের কিছু কিছু লেখা এমন ও হয় , যেগুলো পেশাদার কবি - সাহিত্যিক - লেখকদের ও হার মানাতো । যদি স্বীকৃতি পেতো সাহিত্যজগতে তাঁদের লেখা , হয়তো পেতেন তাঁরা কবি - সাহিত্যিক - লেখকদের স্বীকৃতি ।
এভাবেই অপেশাদার লেখকরা তাঁদের মূল্যবান লেখাগুলো পরিচয় করাতে না পেরে তাঁরা কোনটাসা হয়ে বসে থাকেন ঘরে । মানব সমাজের উপকারী কিছুটা লেখা পর্দার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে । মানব সমাজ বিবিধ উপকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় ।
আর কবি - সাহিত্যিক - লেখকগণ তাঁদের মনের ভাবনাগুলো লিখেন নির্ভয়ে । সেগুলোর পরিচিতি প্রদানে এগিয়ে যান । পেশাদার লেখক হিসাবে দাঁড় করান নিজেদের সাহিত্যজগতে । সাহিত্যজগতে মূল্যায়নের জন্য তাঁদের লেখাগুলো প্রকাশ করেন । স্বীকৃতি মেলে তাঁদের লেখার । মূল্যায়ন হয় তাঁদের ভাবনাগুলোর । স্বীকৃতি পান কবি - সাহিত্যিক - গল্পকার - ছড়াকার - প্রবন্ধকার ইত্যাদি রূপে । মানব সমাজ উপকৃত হয় তাঁদের লেখায় ।
এই যে আমি , অপেশাদার লেখক হিসাবেই লিখে যাই মনের ভাবনাগুলো । নিতান্তই মনোৎসাহে লিখে চলি অনবরত । কাগজ অপচয় করি , আঙ্গুলের ডগা ক্ষয় করি , কলমের কালি নষ্ট করি , সময়ের অবমূল্যায়ন করি , ব্রেইনকে করি অহেতুক জ্বালাতন - এভাবেই , লেখনী জগতে করি আমি বিচরণ ।
নাহ্ , আমি কবি নই , নই কোন গল্পকার , নই উপন্যাসিক , নই কোন ছড়াকার । না আমি প্রবন্ধকার , না আমি লেখক । কোনই পরিচিতি নেই সাহিত্যজগতে আমার । তাতে নেই কোন আক্ষেপ , নেই কষ্ট । না আছে তাতে কিছু প্রাপ্তির আশা , না আসে লেখায় কখনো হতাশা । তবুও লিখি । সেই ছোট বেলা থেকেই আমার লেখার অভ্যাস । সবাই বলতো - আার হাতের লেখা সুন্দর । তাই সোৎসাহে লিখতাম । লিখে চলতাম অবিরত । সেই লেখনীর পথ ধরে চলেছি আজও আমার জীবন চলার পথে ।
মনে পড়ে , চতুর্থ শ্রেণীতে থাকাকলীন সেই পাগলামীর কথা । জন্মস্থান উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার তেরো নম্বর লেলাং ইউনিয়নের অন্তর্গত নিভৃত পল্লীর এক অজপাড়া গাঁ , নাম তার শাহনগর । গ্রামের উত্তর - পূর্ব সীমান্তের সন্যাসীর হাট নামক স্থানে টিনের ছাউনি ঘেরা , নীচ থেকে উপর দিকে অর্ধেক পরিমাণ উঁচু ইট গাঁথা ওয়াল চতুর্দিক , তার উপর ছাদ পর্যন্ত বাঁশের বেড়া । ফ্লোর কিছু মাটি কিছু ব্রিক সলিনে আবৃত - এ ধরণের একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম । আমাদের ক্লাসে ছাত্র - ছাত্রী ছিল পঁচিশ থেকে ত্রিশজন । ছেলে মেয়ে একই সাথে ক্লাস করতাম । সেই স্কুলেই তখন আমি ( শিক্ষকদের দৃষ্টিতে ) চতুর্থ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র ছিলাম । আমার একটা সবুজ সাথী ছিলো , প্রথম শ্রেণীতে পড়ানো হতো তখন । চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেও সেই সবুজ সাথী আমি হাতছাড়া করিনি । প্রথম শ্রেণীতে থাকাকালীন সেই সবুজসাথীর একটা মাত্র কবিতা আমার বড় বোন আমাকে পড়াতো । সেই কবিতাটি হলো -
“ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি ... “
আমার খুব ভালো লাগতো কবিতাটি । চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেও সে কবিতার উক্ত দু’টি চরণ আমি সব সময় চর্চা করতাম । আ ন ম বজলুর রশীদ এমন একটা কবিতা আমার জীবনে উপহার দিয়েছিলেন , যার দু’টি লাইন আজও ভুলতে পারিনি ।
চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন স্কুলের পশ্চিম পার্শের বাড়িটার একই ক্লাসের একটা মেয়ে আমাকে বিভিন্ন অজুহতে প্রায়ই বিরক্ত করতো । মেয়েটির নাম ছিলো শামসুন্নাহার খানম । সবাই তাকে শামসুনি বলেই ডাকতো । মেয়েটির গায়ের রং ছিলো কালো । শরীরের গঠণ ছিলো মাঝারী । আর উচ্চতায় ছিল বেগুন গাছের সমপরিমান । দাঁত গুলো ছিলো তার চিকন , মাছ ধরার ফাঁদ চাই ( চিটাগাং এর আঞ্চলিক ভাষায় ) এর মতো ফলা ফলা সারি বাঁধা। কথা বলতো চিকন গলায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে । তাই তাকে সমপাঠিরা কেচকেচ বলেই ডাকতো ।
দিনের পর দিন দুষ্টামী করতে করতে মেয়েটিকে ভাল চোখে দেখতে শুরু করি । শেষ পর্যন্ত দু’জন দু’জনকে একদিন ন দেখে থাকতে পারতামনা । একদিন দুষ্টুমীর ছলে তাকে একটা ঘুষি দিলে তার নাকে লেগে রক্ত বের হতে থাকে । এরপর দিন থেকে সে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় । এমনকি আমার দিকে দৃষ্টিও দেয়না । মনে কেমন যেন কষ্ট অনুভব হতে লাগল । তার সাথে কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলাম । কিন্তু মেয়েটি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । সম্ভবতঃ আমার সাথে আর কথা বলবেনা বলে সে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলো । উপায় না দেখে আমি নিজেই কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম । কিন্তু , সেদিন নয় , দু’দিন পর । সারারাত চিন্তা করলাম কিভাবে তার সাথে কথা বলা যায় ? সরাসরি তার সাথে কথা বলা অনুচিত মনে করলাম ।
তাই , লিখার মাধ্যমে কথা বলর সিদ্ধান্ত নিলাম । প্রথম চিঠির আঁকারে লিখবো বলে মনে করলাম । আবার তা না করে আমার সবুজ সাথীর প্রিয় দু’টি লাইনের মতো করে দু’টি লাইন লিখে আমার মনের কথা তাকে জানানোর সিদ্ধান্তে আসলাম । রাত চারটার দিকে ঘুম থেকে উঠে শুরু করলাম সবুজ সাথীর মতো দু’টি লাইন লিখতে । অনেক কাটাকাটি , ঘষামাঝায় একটা খাতা বরবাদ করে কাঠপেন্সিল দিয়ে একটা মাত্র লাইন লিখলাম স্কুলের আগে । পরের লাইন লিখলাম স্কুল থেকে আসার পর ।
আমার প্রিয় কবিতার উপরোক্ত দু’টি লাইনের প্যারোডী এভাবেই নিম্নোক্তরূপে মেয়েটিকে লক্ষ্য করে লিখতে হলো -
এমন মনটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ,
সকল মনের সেরা সে যে আমার মনোভূমি ।
নতুন একটা কাগজ খাতা থেকে ছিড়ে তখনকার জনপ্রিয় কলম রেডলিপ বলপেন দিয়ে ঐ দু’লাইন লেখা তাতে সুন্দর করে লিখলাম । সকালে স্কুলে গিয়ে ক্লাস শেষ করে বিকেলে আর পথে জোর করে তাড়াতাড়ি ঐ কাগজটা মেয়েটার কামিজের ভিতরে ডুকিয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে এলাম বাড়িতে ।
---------------------------------------------------------------
চলমান > আমার লেখালেখির অন্তরালে ... (পর্ব - ৩)
মুহাম্মদ জাকারিয়া শাহনগরী
==========================================
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন